উত্তম কৃষি চর্চার আলোকে আম সংগ্রহ ও সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা
ড. মোঃ শরফ উদ্দিন
আম বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী এবং বাণিজ্যিক ফসল। এ দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা মেটাতে মৌসুমি এ ফলটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। আম উৎপাদনকারী এলাকায় আর্থসামাজিক অবস্থা অনেকাংশেই আমের ওপর নির্ভরশীল এবং প্রধান উৎপাদনকারী এলাকার ৮০-৮৫ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমের সাথে জড়িত থাকে। বর্তমানে যে ফলগুলো বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হচ্ছে আম সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিবিএস ২০২২ সালের তথ্য মতে এদেশে ১২.১৪ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা এর তথ্য অনুযায়ী এদেশে আম উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন। অর্থাৎ আমাদের দেশে আমের উৎপাদন চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট। তারপরও বাজারে ভালোমানের আমের অভাব রয়েছে। ফলে আম রপ্তানি কার্যক্রম আশানুরূপভাবে বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। ভালোমানের গুণগত মানসম্পন্ন ও রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনের এখনই উপযুক্ত সময়। এখন থেকে উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করে আম উৎপাদন করা সম্ভব হলে ভালো মানের আম উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
সংগ্রহপূর্ব আম বাগানের যত্ন
আমের গুটি বাঁধার পর পরই শুরু হয় গুটি ঝরা। এরপর দেখা যায় বিভিন্ন রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ। তাই প্রথমে গুটি ঝরা কমানোর জন্য শুকনো মৌসুমে বাগানে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। সেচের সুবিধা না থাকলে গাছে পানি স্প্রে করা যেতে পারে। আম মটরদানা হতে শুরু করে মার্বেলাকৃতি সময় পর্যন্ত বোরণ পাউডার অথবা বোরিক এসিড ১০ লিটার পানিতে ৬০ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করলে ফল ঝরা অনেকাংশে কমানো সম্ভব। আরেকটি গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, প্রতি লিটার পানিতে ২০ গ্রাম হারে ইউরিয়া সার ভালোভাবে মিশিয়ে স্প্রে করেও আমের গুটি ঝরা কমানো যায়। একটি থোকায় বা পুষ্পমঞ্জরিতে ১-২টি আম ভালো ফলনের জন্য যথেষ্ট এর বেশি থাকলে প্রাকৃতিক ঝরা বন্ধ হলে ছিঁড়ে ফেলতে হবে। এ ছাড়াও এই অবস্থায় নিয়মানুযায়ী কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক একত্রে নির্দেশিত মাত্রায় মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। তবে মাটির অবস্থা বুঝে ২৫-৩০ দিন পরপর সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। সেক্ষেত্রে আমের বৃদ্ধি ও ফলন ভালো হবে। আমের ফলছিদ্রকারী ও মাছি পোকা দমনের জন্য অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একটি কথা মনে রাখতে হবে, আমের শরীরে যতবেশি বৃষ্টির পানি পড়বে তত দ্রুত আমের রং নষ্ট হবে এবং সংরক্ষণকাল কমে যাবে। ফলে এদেশের আবহাওয়ায় ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তিটি সবচেয়ে কার্যকরী। আগাম ও মধ্যম জাতের ক্ষেত্রে গুটির বয়স ৪০-৫০ দিন এবং নাবি জাতের ক্ষেত্রে ৫৫-৬০ দিন পর্যন্ত ব্যাগিং প্রযুক্তি গ্রহণ করলে বালাইনাশকের ব্যবহার প্রয়োজন হবে না। এই প্রযুক্তিটি ব্যবহারে ভালোমানের আমের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। আম সংগ্রহের পূর্বে বাগান ব্যবস্থাপনা ভালো হলে আমের সংরক্ষণকাল বেড়ে যায় এবং আমের গুণগতমান ভালো হয়। সুতরাং আমের সংগ্রহ পূর্ব ও সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা সঠিক নিয়মে ও সময়ে বাস্তবায়ন করা জরুরি।
আম সংগ্রহ
আম সঠিকভাবে পরিপক্ব হলেই সংগ্রহ করা উচিত। পরিপূর্র্ণ পুষ্টতায় না পৌঁছানো পর্যন্ত গাছ থেকে আম সংগ্রহ করা উচিত নয় কারণ অপুষ্ট আম ঠিক মতো পাকে না এবং সঠিক রঙ ধারণ করে না। উপরন্তু উপরের খোসা কুঁচকে যায় ফলে বাজারমূল্যে কমে যায়। পরিপূর্ণভাবে পুষ্ট (সধঃঁৎব) হলে আমের উপরের অংশ অর্থাৎ বোঁটার নিচের ত্বক সামান্য হলুদাভ রঙ ধারণ করবে। আমের আপেক্ষিক গুরুত্ব ১.০১ - ১.০২ এর মধ্যে থাকবে অর্থাৎ পরিপক্ব আম পানিতে ডুবে যাবে। প্র্রাকৃতিকভাবে দুই একটা পাকা আম গাছ থেকে ঝরে পড়বে এবং পাখিতে আধাপাকা আম ঠোকরাবে। উপযুক্ত সময়ের আগে বা পরে সংগ্রহ করলে পরবর্তীতে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। আম সংগ্রহ করতে হবে অত্যন্ত যতেœর সাথে। আম গাছ হতে আম দুইভাবে সংগ্রহ করা যায়, হাত দিয়ে এবং সংগ্রাহক ব্যবহার করে। গাছের উচ্চতা কম হলে তা সহজেই হাত দ্বারা সংগ্রহ করা সম্ভব কিন্তু গাছের উচ্চতা বেশি হলে বাঁশের তৈরি আম সংগ্রহক বা ঠুসি (গধহমড় যধৎাবংঃবৎ) ব্যবহার করা হয়। গাছ থেকে আম সংগ্রহ করতে হবে মেঘমুক্ত, রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে এবং সকাল বেলায়। আম কিছুক্ষণ উপুড় করে রাখতে হবে যাতে আঠা ঠিকমত ঝরে পড়ে ও আমের গায়ে না লাগতে পারে। আমের কষ ঝরানোর জন্য আঠা ঝরানো যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। আম সংগ্রহ করার পর যত দ্রুত সম্ভব আমগুলোকে ঠা-া জায়গায় সরিয়ে নিতে হবে। বাজারজাতকরণের সুবিধার্থে দফায় দফায় আম পাড়া যেতে পারে। গাছ থেকে আম সংগ্রহ করার ১২-১৫ দিনের মধ্যে আমগাছে কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক স্প্রে করা উচিত নয়। বালাইনাশক স্প্রে করা এবং ফল সংগ্রহ করার মধ্যবর্তী পার্থক্য মেনে চললে স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক কমে আসে।
বাছাইকরণ বা গ্রেডিং
সংগৃহীত আমের সুষ্ঠু বাজারজাতকরণের সুবিধার্থে বাছাইকরণ একান্ত প্রয়োজন। আঘাতপ্রাপ্ত, রোগাক্রান্ত, পোকার দ্বারা আক্রান্ত এবং গাছ পাকা আম পৃথক করে রাখতে হবে কারণ এসব আম খুব তাড়াতাড়ি পচে যায়। দুরবর্তী বাজারে বা রপ্তানির জন্য স্বাভাবিক, উজ্জ্বল এবং পরিপুষ্ট আম বাছাই করে প্যাকিং করা উচিত। যে কোনো ফল প্যাকিং এর আগে ছোট, মাঝারি এবং বড় এই তিন ভাগে ভাগ করা উচিত যাতে প্যাকিং, পরিবহন ও বাজারজাতকরণে সুবিধা হয়।
সংগ্রহোত্তর পচন রোধ
আম গাছ থেকে সংগ্রহ করার পর আমের পচন জনিত রোগ দমন করতে হবে। আম রোগমুক্ত রাখা বা সংগৃহীত আমের পচন রোধ করার জন্য বালাইনাশকের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি ব্যবহার করা উচিত যেমন- গরম পানিতে আম শোধণ এবং বাষ্পীয় আম শোধন। এক্ষেত্রে গাছ থেকে ফল সংগ্রহের কিছুক্ষণ পরই ৫৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ৫-৭ মিনিট ডুবিয়ে রাখলে আমের সংগ্রহোত্তর পচন দমন করা যায়। তবে উন্নত দেশে আম সংগ্রহের পর নির্দিষ্ট মাত্রায় ছত্রাকনাশক ব্যবহার করে আমকে শোধন করা হয়।
প্যাকিং
আম সংগ্রহের পর ভোক্তার নিকট পৌঁছানোর জন্য আমের যে ব্যবস্থাপনা করা হয় তাকে প্যাকিং বলে। আম দূরবর্তী স্থানে পাঠানোর জন্য প্যাকিং একান্ত প্রয়োজন। কেননা আমের শরীর বেশ নরম এবং সামান্য আঘাতে জখম হতে পারে এবং তাতে জীবাণুর সংক্রমণ ঘটতে পারে। আম প্যাকিংয়ের সময় নিম্নলিখিত নিয়ম মেনে চলা উচিত। আমাদের দেশে আম প্যাকিংয়ে প্রধানত বাঁশের ঝুড়ি ব্যবহার করা হয়। বাঁশের ঝুড়ির চাইতে ছিদ্রযুক্ত কাঠের বাক্সে আম পরিবহন বেশি যুক্তিসঙ্গত। তবে সবচাইতে ভাল ব্যবস্থা হলো প্লাস্টিকের ক্রেটসে আম পরিবহন। তবে সম্ভব হলে প্যাকেটের তলায় কিছু খড় বিছানো এবং প্রতিটি আমকে টিস্যু পেপার বা খবরের কাগজ দ্বারা মোড়িয়ে দেওয়া ভালো। প্র্রত্যেক প্যাকেটের গায়ে ফলের নাম, জাতের নাম, প্রাপকের নাম ইত্যাদি লিখে রাখা উচিত। প্যাকিংয়ের আগে আমকে গরম পানিতে ট্রিটমেন্ট করলে আমের রঙ কিছুটা হলুদ হয় এবং বেশ কিছুদিন রোগমুক্ত থাকে। গরম পানিতে ট্রিটমেন্ট করলে আমের স্বাদ বেড়ে যায়।
পরিবহন
আমাদের দেশে আম প্রধানত সড়ক পথেই পরিবহন করা হয় কারণ এতে সময় অল্প লাগে। তাছাড়া বাগান থেকে বাজারে আম পরিবহনের জন্য সাইকেল, রিকশা, ভ্যান, অটোরিকশা, নৌকা ও গরুর গাড়ি ব্যবহার করা হয়। আম ফল পরিবহনে নিম্নলিখিত সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
যানবাহনে আম উঠানো, নামানো ও পরিবহনের সময় সতর্ক থাকতে হবে যেন ফলের গায়ে বা প্যাকেটে আঘাত না লাগে; পরিবহনে বেশি সময় নষ্ট না করাই ভালো কারণ তাতে আম পচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে; পরিবহন শেষ হলেই প্যাকেট খোলা ও আম গুদামজাত করা উচিত; গাদাগাদি করে আম পরিবহন করলে নিচের আমে বেশি চাপ পড়ে ও আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
গুদামজাতকরণ/ সংরক্ষণ
গাছ থেকে আম সংগ্রহ করার পর বিক্রয় পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে আমকে গুদামজাত বা সংরক্ষণ করার প্রয়োজন দেখা দেয়। যে কোন ফল গাছ থেকে সংগ্রহ করার পরও তার মধ্যে বিভিন্ন জৈবিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। তাই আম গুদামজাত করার সময় নিম্নলিখিত সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
যে ঘরে আম রাখা হবে তা অবশ্যই বাতাস চলাচলের উপযোগী ও শীতল হতে হবে। প্রয়োজনে ইলেকট্রিক ফ্যান ব্যবহার করা যেতে পারে; আর্দ্র আবহাওয়ায় ও বদ্ধ ঘরে আম তাড়াতাড়ি পাকে এবং সহজে পচন ধরে যায়। ফলে পাকা আম বেশি দিন গুদামে সংরক্ষণ না করে তাড়াতাড়ি বিক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে; ঘরের তাপমাত্রা যত কম হবে ততই উত্তম। তবে ২০-২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করলে আমের ওজন হ্রাস কম হয়।
বাজারজাতকরণ
যে কোন জিনিস বাজারজাতকরণ একটি সুন্দর আর্ট। দক্ষ ব্যবসায়ীগণ বিক্রয়যোগ্য দ্রব্যসামগ্রীকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলেন যাতে ক্রেতাসাধারণ অতি সহজেই আকৃষ্ট হয়। আম বাজারজাতকরণের সময় নিম্নলিখিত নিয়ম মেনে চলা উচিত।
বেশি পাকা আম আগে বিক্রয় করতে হবে; কোন আমে পচন দেখা মাত্রই আলাদা করে রাখতে হবে কারণ এর জীবাণু অন্যান্য সুস্থ আমকে আক্রমণ করে; ছোট, মাঝারি ও বড় এ তিন আকারের ফল বাছাই করে বাজারজাত করতে হবে; বাজারজাতকৃত আমের গাদায় জাতের নাম এবং দর লিখে রাখতে হবে।
পরিশেষে, পছন্দনীয় এ ফলটির সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমানো এবং উৎপাদন বাড়ানোর জন্য আম উৎপাদন, সংগ্রহ, পরিবহন ও বাজারজাতকরণের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে একসাথে কাজ করতে হবে। দেশের সকল ভোক্তাগণ মৌসুমী ফল আম হতে প্রত্যেকটি জাতের আসল স্বাদ পাবেন এই প্রত্যাশাই গবেষকদের। ভালোমানের আম উৎপাদন নিশ্চিত হলে তা দেশের মানুষের পষ্টির চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে এবং আম রপ্তানির পরিমাণও বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। সেক্ষেত্রে আম চাষিরা আর্থিকভাবে লাভবান হবেন ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে এবং দেশে অর্থনীতি আরো দৃঢ় ও মজবুত হবে।
লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, গাজীপুর, মোবাইল: ০১৭১২১৫৭৯৮৯, ই-মেইল: ংড়ৎড়ভঁ@ুধযড়ড়.পড়স